অনলাইন ডেস্ক॥
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পশ্চিমের উপেজলা নবীনগর। অত্যন্ত উর্বর, ধনে, জনে ও মননশীলতায়। এই বিখ্যাত তিতাস নদীর কূলঘেষে গড়ে ওঠা প্রাচীন জনপদের নাম কৃষ্ণনগর। বিভিন্ন কারণে এই গ্রামটি বেশ প্রসিদ্ধ। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই গ্রামে ১৮৭৯ সালে ৩১ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন ভারতীয় উপমহাদেশের পুতুল নাচের জনক হিসেবে পরিচিত বিপিন দাস। তার পিতার নাম বৃন্দাবন দাস। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান হয়ে জন্ম নিয়েও তিনি গুরুগৃহে প্রাথমিক পর্যায়ের লেখাপড়া শিখে শৈশব-কৈশোর কাটান। সেই সময়ে মনতলা ঘাট হতে গয়না ও মাল বোঝাই নৌকা ও জাহাজ নারায়ণগঞ্জ হয়ে কলকাতায় আসা-যাওয়া করত। এইসব জাহাজের দায়িত্বে থাকা পিতামহ গগন দাসের সঙ্গে কিছু সময় বিপিনও এই কাজ করেছিলেন বলে তাকে অনেকে বিপিন মাঝি বলে থাকেন। সেই সময মাটির তৈরি পুতুল দেখে কৈশোর বয়সেই তার কচি মনে প্রশ্ন জাগে, এগুলোকে যদি নাচানো যেত, তাহলে নৃত্যের তালে তালে অনেক কিছু বলা যেত। তার পেরর ইতিহাস অনেক দ্রুত বদলে যায়। জানা যায়, বিপিন দাসই প্রথম আধুনিক পুতুল নাচের প্রচলন করেন। তিনি তৎকালীন সময়ের সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় পৌরাণিক কাহিনী অবলম্বনে পুতুল নাচ করতেন বলে জানা যায়। এছাড়াও গ্রামীণ জীবনের নানা দৃশ্যপট তুলে ধরা হয় এতে। কখনও কাঠুরিয়াকে বাঘের আক্রমণ, কখনওবা জেলেদের কুমির খেয়ে ফেলার করুণ পরিণতি তুলে ধরা হয়েছে। এই পুতুল নাচ দেখার জন্য শিশু-বৃদ্ধ থেকে শুরু করে সকল শ্রেণি-পেশার লোকের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো ছিল। পুতুল নাচ দেখে শিশুদের আনন্দকে আরও ছড়িয়ে দিতে তিনি প্রথমে মাটির পুতুল, দেবদেবীসহ বিভিন্ন আকৃতির পুতুল তৈরি শুরু করে ক্রমান্বয়ে স্টিক পুতুল, স্প্রিং পুতুল ও সুতোর তৈরি পুতুল বানান। তিনি একই এলাকার কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে পুতুল নাচ সৃষ্টির মাধ্যমে চমক তৈরি করেছিলেন। কালক্রমে তা ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন স্থানে।
পরে এ শিল্পের হাল ধরেন জেলার কৃষ্ণনগর গ্রামের গিরীশ আচার্য্য, মো. তারু মিয়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের মেড্ডা এলাকার ধন মিয়া, কালু মিয়া ও মো. রাজ হোসেন। তারা নিজেরাও পুতুল নাচের দল তৈরি করেছিলেন এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ বৃহত্তর কুমিল্লা, ময়মনসিংহ, নরসিংদী, বিক্রমপুর, সিলেট, নোয়াখালী, চট্রগ্রামসহ সারাদেশ ব্যাপী এই পুতুল নাচ দলের পদচারণায় মুখরিত করে তুলেন। তাছাড়া ওই সময় ফরিদপুর ও রাজশাহী অঞ্চলের কিছু কিছু এলাকায় পুতুল নাচের প্রচলন ও জনপ্রিয়তা আলোড়ন তৈরি করেছিল।
বিপিন দাস তার দুই ছেলে গোপাল দাস ও গোবিন্দ দাসকে এই পেশায় শিক্ষা দেন এবং তারাও ওস্তাদ হয়ে বিপিন দাসের স্বপ্নের পুতুল নাচ ভারতে ছড়িয়ে দেন। ওস্তাদ গোপাল দাস বাবা বিপিনের নির্দেশে ভারতে গিয়ে বিভিন্ন এলাকায় শিষ্য তৈরি করে পুতুল নাচের দল গঠন করেন। ফলে পুরো ভারতবর্ষে এর জনপ্রিয়তা ও বিপিন দাসের পরিচিতিসহ বাড়তে থাকে। শুধু ভারতই নয়, তিনি পুতুল নাচের দল নিয়ে পৃথিবীর প্রায় ২৭টি দেশ ভ্রমণ করেন।
পুতুল নাচের শিল্পী খেলু মিয়া দেশের একটি গণমাধ্যমকে বলেন, আমি যখন স্কুলে পড়তাম তখন থেকে বাবার সঙ্গে মেলাতে আসা যাওয়া করতাম। সে সময় থেকে এ খেলা দেখতে দেখতে নিজের মধ্যে শেখার একটা আগ্রহ তৈরী হয়। বাবা হোসেন আলী মারা যাওয়ার পর আমি এ পেশার হাল ধরি। তিনি বলেন, দেশের বিভিন্ন জেলায় ঘুরে ঘুরে পুতুল নাচ দেখিয়ে মানুষের মধ্যে আনন্দ দিতাম। বিভিন্ন প্রোগ্রাম থাকত এবং অনেক প্রজেক্টের কাজও করতাম।
পুতুল নাচকে টিকিয়ে রাখার পরবর্তী প্রজন্ম আসতে চাইবে কি না? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের ছেলে-মেয়েদেরকে এ কাজটা এখন শিখাতে চাই না। কারণ আমাদের নিজেদের এখন দূরাবস্থা। যার কারণে ছেলে-মেয়েদের অন্য কাজের দিকে মনোযোগী হতে হচ্ছে। দিন দিন এ খেলাটি বিলুপ্তিতর পথে চলে যাচ্ছে।
এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সরকারের সহযোগিতা প্রয়োজন বলেও জানান তিনি।
বাণী বিণা দলের মাষ্টার কবির হোসেন বলেন, ৩০ বছর ধরে পুতুল নাচের মাধ্যমে নাটক এবং বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান করে আসছি। আগে প্রদর্শনী করে ভালো টাকা রোজগার করা যেত। এখন আগের মতো প্রোগ্রাম পাই না। বাধ্য হয়ে অন্য কাজ করতে হচ্ছে। সরকারে কাছে আমাদের দাবি বছরে ৬-৭ মাস আমাদের প্রোগ্রামের ব্যবস্থা করে দিলে তাহলে পরিবার নিয়ে চলতে পারব।
এ বিষয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সংস্কৃিতজন কবি আব্দুল মান্নান সরকার বলেন, পুতুল নাচ এক সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটি ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির অংশ ছিল। এবং সারাদেশে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পুতুল নাচকে গুরুত্ব দেওয়া হত। এমন কি পুতুল নাচে যারা প্রয়াত শিল্পী ছিলেন তারা বিদেশে গিয়েও এই খেলার প্রদশনী করেছেন। কিন্তু কালের বিবর্তনে পুতুল নাচের শিল্পীরা অনেকটা পর্দার অন্তরালে চলে যাচ্ছেন। অনেকে এই পেশা ছেড়ে দিচ্ছেন। কারণ পর্যাপ্ত পৃষ্টপোষকতা দেওয়া হচ্ছে না।
তবে এ শিল্পকে বাঁচাতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন বলে দাবী করেন কবি ও কথাশিল্পী শৌমিক ছাত্তার। তিনি বলেন, পুতুল নাচ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাংস্কৃিতক ঐতিহ্যের বড় অংশ দখল করে আছে। এখনো বিভিন্ন দিবসে পুতুলনাচ অনুষ্ঠানে মানুষের ঢল নামে। কাজেই এই শিল্পের পৃষ্ঠেপাষকতা দরকার।
বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক কবি ও কথাশিল্পী ডক্টর শাহ মোহাম্মদ সানাউল বলেন, প্রযুক্তির প্রসারের কারণে অনেক কিছুই হারিয়ে যাচ্ছে এবং যাবে। বলতে পারেন এটা সময়ের দাবী পূরণ করছে। সময়ের বিবর্তনে পুরাতনকে জায়গা ছেড়ে দিতে হয় নতুনের জন্য-এটাই নিয়ম। যেহেতু পুতুল নাচটি আমাদের এই অঞ্চলরে ঐতিহ্য, সেইহেতু এটাকে হারিয়ে যেতে দেওয়া যাবে না। তিনি বলেন, সামাজিক যাদুঘরে রেখে দিতে হবে। আপনি চাইলে শোপিস হিসেবেও রাখা যেতে পারে।(তথ্যসূত্র: ঢাকা মেইল অনলাইন)
+ There are no comments
Add yours