কালের সাক্ষী লেটার প্রেস এখন আর নেই

Spread the love


রুদ্র মোহাম্মদ ইদ্রিস॥ আমাদের এই ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আমি যখন হাই স্কুলে পড়ি, তখন দেখতাম মসজিদ রোডের জুবিলি প্রেস আর কাজীপাড়ার প্রতিচ্ছবি প্রেস ছিলো। এছাড়াও আরও অনেক প্রেস ছিলো, কিন্তু আমার আসা যাওয়া ছিলো না। সেখানে অনেকের কাজ আমি দাঁড়িয়ে থেকে থেকে আগ্রহ ভরে দেখেছি। আজ হয়তো অনেকের নাম মনে নেই বা বলতে পারবো না, তবে জুবিলি প্রেসে আমাদের সুহিলপুরের একজনকে কাজ করতে দেখতাম। এছাড়া এই প্রেস ও দৈনিক প্রজাবন্ধু পত্রিকার মালিক প্রয়াত মহিবুর রহমান ভুঁইয়া, যাকে আমি মলাই মামার বন্ধু হিসেবে মামা ডাকতাম, তাঁকে দেখেছি, মাঝে মধ্যে ছোট ছোট লিফলেট কিংবা ক্যাশ মেমো তিনি নিজেই কাজ করে ফেলতেন।
আর কাজীপাড়ায় প্রতিচ্ছবি প্রেসে দেখেছি, প্রয়াত সৈয়দ মো.আনোয়ারুল ইসলাম, তিনি মূলত দৈনিক হালচাল পত্রিকার বার্তা বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন আমৃত্যু। তাঁকেও আমি মামা ডাকতাম। মামাকে এই কাজ মাঝে মধ্যে করতে দেখতাম। তবে এই দুজনই সাংবাদিক ছিলেন। কিন্তু অনেক সময় তারা এই কাজটা নিজেদের প্রয়োজনে করতেন। বিশেষ করে প্রুফ দেখাটাই বেশি করতেন। একটা কথা আমার মনে আছে, একটি ছোট পত্রিকার এক পৃষ্ঠা কাজের বিনিময় ছিলো তখনকার সময়ের ৫০ টাকা। সময়টা নব্বইয়ের আগের। তবে একজন ব্যক্তি দুই পৃষ্ঠা কাজও করতে পারতেন। একটির পর একটি বর্ণ বসিয়ে শব্দ তৈরি করে অন্তহীন খাটুনিতে লেটার প্রেস বা ট্রেডল মেশিনে ছাপা হতো পত্রিকা। আজকের আধুনিক যুগের আধুনিক অফসেট প্রেসের বদৌলতে পাঠক ঝকঝকে ছাপা পত্রিকা হাতে পেলেও সেই স্বর্ণযুগে পাঠক খুব সহজেই ঝকঝকে ছাপা পত্রিকা পেত না। প্রকাশনার পেছনের কারিগরদের দিন-রাতের পরিশ্রমে বের করতে হতো একটি পত্রিকা। বানান সঠিক তো ভালো; না হলে পাঠকের আর সম্পাদকের বকাবকিতেই মানুষিকভাবে শেষ হয়ে যেত প্রকাশনার পেছনের কারিগরটি। জানা যায়, ছোট একটি টুলে বসে সামনের টেবিলের ডানপাশে, বামপাশে ছোট ছোট অনেক খোপের কাঠের পাত্র থাকত। সেসব খোপে সিসা দিয়ে বানানো উল্টো করে তৈরি বাংলা বা ইংরেজি বর্ণ থাকত। একেকটি খোপে একেক ধরনের বর্ণ থাকত। খোপ থেকে একটি একটি করে বর্ণ তুলে নিতেন। তারপর একটির পর একটি বর্ণ বসিয়ে শব্দ তৈরি করতেন। যেমন- বই লিখতে হলে ‘ব’ বর্ণেও খোপ থেকে ‘ব’ এবং ‘ই’ বর্ণের খোপ থেকে ‘ই’ নিয়ে পাশাপাশি বসিয়ে তৈরি হতো ‘বই’ শব্দটি। এভাবে অনেক শব্দ বসিয়ে একটি বাক্য তৈরি হতো। অনেক বাক্য দিয়ে একটি লেখা তৈরি করে ‘গ্যালি’ নামের একটি কাঠের পাত্রে বর্ণগুলো রাখা হতো। গ্যালিতে রাখা সেসব উল্টো বর্ণের গায়ে রোলার দিয়ে কালি লাগানো হতো। তারপর কালিমাখা সেসব বণের ওপর বিশেষ একটি পদ্ধতিতে নিউজ প্রিন্টের একটি কাগজ চাপ দেওয়া হতো। তখন সেই নিউজ প্রিন্টের কাগজে বর্ণগুলো ফুটে উঠতো। তারপর দেখা হতো বানান ঠিক হয়েছে কি না। ছাপা কাজে ভুল হলে ভুল বর্ণ সরিয়ে সঠিক বর্ণ বসানো হতো। প্রুফ দেখার পর গ্যালিতে সাজানো বর্ণ মেশিনে সেট করে কাগজে ছাপানো হতো। বর্ণ বা লেটার বসিয়ে ছাপার কাজ হতো। এভাবেই কাজ হতো লেটারপ্রেস বা ট্রেডল মেশিনে। প্রথম দিকে সেসব মুদ্রণযন্ত্র বিদ্যুৎ ছাড়া পা দিয়ে ঠেলে ঠেলে চালানো হতো। ছাপার কাজ। এরপর সেসব মেশিনে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়।

About The Author

You May Also Like

More From Author

+ There are no comments

Add yours