হারিয়ে যাচ্ছে যৌথ পরিবার ॥ বাড়ছে পারিবারিক সহিংসতা

Spread the love

রুদ্র মোহাম্মদ ইদ্রিস ॥ পরিবার হচ্ছে আদিম যুগের একমাত্র আদিম প্রতিষ্ঠান, মানবসভ্যতার মৌলিক প্রতিষ্ঠান, সৌহার্দ্য-ভালোবাসার বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠান। নিজেদের অস্তিত্বের প্রয়োজনের তাগিদ থেকেই আদিম যুগে মানুষের মধ্যে সংঘবদ্ধভাবে বাস করার প্রবণতা ছিল। সেই থেকেই পরিবারের উৎপত্তি। এক সময় গ্রাম বা শহরে অনেক যৌথ পরিবার দেখা যেত। মানুষের পুকুরভরা মাছ ছিল, ক্ষেতজুড়ে ধান ছিল, গোয়ালভরা গরু বাছুর ছিল। যৌথ পরিবারে অনেক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ছিল। অবস্থাভেদে প্রতিটি পরিবারে সদস্য ছিল ২০ থেকে ৩০ জন। কোথাও বা এর চেয়ে কম বেশি। পরিবারের কর্তার আদেশ সবাই মেনে চলত। ভাই-বোনের মধ্যে সুসম্পর্ক থাকত। বিয়ে বিচ্ছেদ হতো কম। পৃথিবী যত এগিয়ে যাচ্ছে, যৌথ পরিবার ততো কমে যাচ্ছে। হারিয়ে যেতে বসেছে যৌথ বা একান্নবর্তী পরিবারের সুবিধা, ঐতিহ্য; সেই সঙ্গে ভেঙ্গে যাচ্ছে সামাজিক বন্ধন।
ছোট বেলায় আমরা দেখেছি গ্রামের সকল মানুষ সামাজিক আচার পালনে বাড়ির উঠোনে, পুকুর পাড়ে বা স্কুলের মাঠে বসে সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এখন সেই বসা হয় গ্রামের বা হাট বাজারের কোন ব্যক্তির ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। গ্রামের স্কুল মাঠ বা পুকুর ঘাটের খোলা বাতাস গায়ে লাগিয়ে মানুষ থাকে প্রানবন্ত। সেখানে ছোট বড় ধনী গরীব বিচারে নয় অভিজ্ঞতার আলোকে আলোচনা, মতামত এবং সিদ্ধান্ত হয়। তারই ভিত্তিতে গ্রামের সকল মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে সামাজিক এই কর্মকান্ডগুলো সম্পন্ন করে। এই কাজে থাকে না ভেদাভেদ, থাকেনা কোন স্বার্থ। পরিবারে পরিবারে এক সেতুবন্ধন ছিলো সামাজিক এই অনুষ্ঠান গুলো। গ্রামে গ্রামে জিয়াফত আর হয় না। এই জিয়াফতে মূলত গ্রামের সবাই একত্রিত হত খাওয়া-দাওয়া করত গ্রামের সবাই একসাথে মিশত। আশেপাশের গ্রামের মানুষেদেরও দাওয়াত দেয়া হতো সেই জিয়াফতে। কতজনকে কত ভালো খাওয়ানো যায় এরকম একটা মানসিক প্রতিযোগিতা দেখা যেতো এই ২০-৩০ বছর আগেও এমনটা ছিলো। এখন গ্রামে গ্রামে এসব হয় না।
মানুষের পবিত্র আশ্রয়ের অদ্বিতীয় এ সংগঠনটি ভেঙে যাচ্ছে ঠুনকো কারণে, মাঝে মাঝে তা হয়ে উঠছে রণক্ষেত্র। পারিবারিক বন্ধন আলাদা হয়ে যাওয়ায় বৃদ্ধি পাচ্ছে পারিবারিক অস্থিরতা ও পারিবারিক সহিংসতা, যা নিশ্চিতভাবে সমাজ ও রাষ্ট্রে সংক্রমিত হচ্ছে।
যৌথ বা একান্নবর্তী পরিবারের বদলে এখন ফ্ল্যাটভিত্তিক পরিবারের বিকাশ ঘটেছে। সচরাচর বাবা-মায়ের স্থান হয় না এসব ফ্ল্যাট পরিবারে। আগে যেসব কাজকে পারিবারিক কাজ হিসেবে গণ্য করা হতো এখন তা পরিবারের বাইরেই হয়। কারও অসুখ হলে পারিবারিক সেবার চেয়ে হাসপাতালকে দেয়া হয় প্রাধান্য। উপার্জন অক্ষম সদস্যকে পারিবারিক বন্ধনের বাইরে রাখার প্রবণতা বিপজ্জনক হারে বাড়ছে। মানুষে মানুষে দূরত্ব বাড়ছে এই একমাত্র পরিবার প্রথা ভেঙ্গে যাবার কারণে।
এদিকে ছোট পরিবার বা একক পরিবারে স্বামী স্ত্রী দুজন আর দুয়েকজন সন্তান থাকার কারণে নিজেদের বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য তৃতীয় কোন পক্ষ সেখানে থাকে না। কারণ এসব পরিবারে অভিভাবক বলতে আমরা যাদের বুঝি, তারা তাদের সাথে থাকেন না। এরফলে বাড়ে সামাজিক অস্থিরতা। পারিবারিক সহিংসতা- এমনটাই মনে করেন সিনিয়র শিক্ষক মো. রফিকুল ইসলাম।
এর আরেকটি দিক হলো, আমি এমন অনেক একক পরিবারের গল্প জানি যারা সন্তানকে শিক্ষিত করতে গ্রামের বাড়ি ছেড়ে শহরে অবস্থান করছেন। এক সময় জীবিকার প্রয়োজনে পরিবারের কর্তা ব্যক্তি দেশের বাইরে পাড়ি জমান। আর এদিকে নারী অভিভাবক জড়িয়ে পড়েন পরকীয়ায়। সিনিয়র শিক্ষক মো. রফিকুল ইসলাম যোগ করেন। তিনি আরও বলেন, যতো রকমের সামাজিক অস্থিরতা তৈরী হয়, তা অনেক ক্ষেত্রেই মানুষের অবাধ চলাফেরা, পরিবারের শাসন না থাকা, ধর্মীয় মূল্যবোধের অভাব এবং মূল পরিবার থেকে দূরে থাকার কারণে ঘটতে পারে-এমনটাই ধারণা করেন তিনি।
এডভোকেট নাসরীন পান্নার মতে, আমি যৌথ পরিবারেই বড় হয়েছি। আমার শৈশব কেটেছে খুলনায়। এখন আমি স্বামী সন্তান নিয়ে ঢাকায় থাকি। আমি বিশ্বাস করি যৌথ পরিবার গুড। বাট আমি তো এখন ব্যাক করতে পারবো না। আমরা তো এখন একটা সামাজিক একক পরিবারের টানেলে ঢুকে গেছি। তবে নিজেদের মধ্যে ভালো বোঝাপড়া থাকার দরকার আছে। তিনি বলেন, পরিবারের আমাদের বাবা-মা কেউই বেঁচে নেই। কিন্তু ভাসুর আছেন-খুলনায়। আমরা তাকে শ্রদ্ধা ও ভয় করি। কিছু করার আগে তার সাথে পরামর্শ করি। যদিও কোনো একটা কাজে দরকার নাই তবুও পরামর্শ করি। তিনি আমাদের মুরুব্বী। গুরুজন। এরফলে আমাদের একক পরিবারেও শান্তি বিরাজ করে। আমাদের একটা অভিযোগের শাসনের জায়গা আছে, এটা থাকা অনেক ভালো। তিনি বলেন, একক পরিবারে থেকেই আমরা হোয়াটআপ ব্যবহার করে যৌথ পরিবারের মতো সবকিছু মেনে চলি।

About The Author

You May Also Like

More From Author

+ There are no comments

Add yours