শরতের মুগ্ধতা শাপলার রাজ্য সাতলায়

Spread the love


অনলাইন ডেস্ক॥
বরিশালের উজিরপুর উপজেলার সাতলা ইউনিয়নের সাতলা বিল বাংলাদেশের একটি অনন্য পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত, যা হাজারো লাল শাপলার সৌন্দর্যে সজ্জিত। বিলটি প্রতি বছর জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত শাপলার স্বর্গরাজ্যে রূপান্তরিত হয়।
ভোরের সূর্যোদয়ের আলো যখন শাপলার পাপড়িতে পড়ে, তখন পুরো বিল যেন এক স্বপ্নপুরীতে পরিণত হয়। সেই সময় নৌকায় করে বিলের গভীরে গিয়ে লাল, সাদা, ও বেগুনি শাপলার মোহনীয় সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারা এক অসাধারণ অনুভূতি দেয়।
বিলের প্রতিটি কোণে ছড়িয়ে থাকা লাল শাপলা যেন প্রকৃতির নিজস্ব একটি চিত্রকলা। বর্ষার পানিতে বিলে শাপলার মেলা শুরু হলে দূর-দূরান্ত থেকে পর্যটকেরা এই মুগ্ধকর দৃশ্য উপভোগ করতে সাতলা বিলের দিকে ছুটে আসেন। বিলের মাঝখানে নৌকায় ঘুরে বেড়ানো একদিকে যেমন মনোমুগ্ধকর, তেমনি শান্ত পানির উপরিভাগে ভাসমান শাপলার পাপড়ির লাল ছোঁয়া মনকে প্রশান্তিতে ভরিয়ে তোলে।
সাতলা বিলের আশেপাশে থাকা গ্রামবাসীদের জীবনযাত্রা বিলে ওঠা-নামার সঙ্গেই গভীরভাবে জড়িয়ে আছে। বর্ষাকালে যখন বিলের পানি বেড়ে যায়, তখন তাঁদের যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম হয়ে ওঠে নৌকা। বিলে মাছ ধরা, শাপলা সংগ্রহ করা এবং জলজ সম্পদে নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করা গ্রামের মানুষের দৈনন্দিন কাজ। এই অঞ্চলের মানুষেরা খুবই সরল ও বন্ধুসুলভ, যাঁরা অতিথিদের আন্তরিকতায় আপ্যায়ন করে থাকেন। গ্রামবাসীদের সাধারণ জীবনযাত্রা হলেও তাঁদের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতিতে পাওয়া যায় মাটির তৈরি বিভিন্ন শিল্পকর্ম, যা তাঁদের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। সাতলার গ্রামগুলোতে বিভিন্ন উৎসব ও মেলাগুলোতেও এই ঐতিহ্যের ছোঁয়া দেখতে পাওয়া যায়।
সাতলার ঐতিহ্যবাহী খাবার ও অতিথিপরায়ণতা:
সাতলা ইউনিয়নে গেলে স্থানীয় কিছু খাবারের স্বাদ নিতে ভুলবেন না। গ্রামের কিছু ছোট হোটেলে সহজ-সরল, অথচ সুস্বাদু খাবারের স্বাদ পাওয়া যায়। এই খাবারগুলো গ্রামবাসীদের ঐতিহ্য এবং সহজ জীবনযাত্রার পরিচায়ক। বরিশাল শহরে অনেক রেস্টুরেন্টে বিভিন্ন ধরনের ঐতিহ্যবাহী খাবার পাওয়া যায়, যেমন- পান্তা ভাত, ইলিশ ভাজা, চিতই পিঠা, মুগের ডাল, ইত্যাদি।
কীভাবে যাবেন সাতলা বিলে?
ঢাকা থেকে বরিশাল পৌঁছাতে হলে সড়ক, নৌপথ, বা বিমানপথে যেতে পারেন। সড়ক পথে গাবতলী থেকে ভোর ৬টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত বাস বরিশালের দিকে রওনা দেয়। সাধারণত বাসগুলো মাওয়া ও পাটুরিয়া হয়ে বরিশাল পৌঁছে। ভাড়া এসি বাসে ৭০০-৮০০ টাকা এবং নন-এসি বাসে ৫০০ টাকা। নৌপথে বরিশাল যেতে চাইলে সদরঘাট থেকে রাত ৮টা থেকে ৯টার মধ্যে বিভিন্ন লঞ্চ বরিশালের দিকে রওনা দেয়। সেখানে ডেকের ভাড়া ১৫০ টাকা, ডাবল কেবিনের ভাড়া ১৬০০ টাকা, এবং ভিআইপি কেবিনের ভাড়া ৪৫০০ টাকা। বরিশালে পৌঁছে নথুল্লাবাদ বাসস্ট্যান্ড থেকে সাতলা পৌঁছাতে হয় শিকারপুর পর্যন্ত বাসে করে এবং সেখান থেকে অটো ভাড়া করে যাওয়া যায়।
সাতলা বিলে ঘোরার সুবিধা:
সাতলা বিলে ঘোরার জন্য স্থানীয়ভাবে ছোট ছোট নৌকা ভাড়া পাওয়া যায়। এতে করে আপনি বিলে ঘুরে শাপলার সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন। নৌকায় ভ্রমণ করার সময় শাপলার মাঝে যেভাবে সাদা বক, পানকৌড়ি, মাছরাঙা, ফিঙে, শালিক, দোয়েল পাখির দল খেলা করে, তা প্রকৃতিপ্রেমীদের মন জয় করে নেয়। গ্রামবাসীদের জীবনযাত্রা, তাদের অতিথিপরায়ণতা, এবং শাপলার বিলের মুগ্ধকর দৃশ্য – সব মিলিয়ে সাতলা বিল একটি অমর স্মৃতির মতো হয়ে থাকে।
খাবারের ব্যবস্থা:
সাতলার ভেতরে খাবারের তেমন কোনো স্থায়ী ব্যবস্থা নেই। বিলের পাশে কিছু ছোট ছোট দোকান থাকলেও পর্যাপ্ত খাবার পাওয়া যায় না। বরিশাল শহরে যাওয়ার পর স্থানীয় কিছু হোটেল এবং রেস্টুরেন্টে পছন্দের খাবার পেতে পারেন। বিশেষ করে মাছের তরকারি, চিতই পিঠা, দুধ চিতই, নারকেল চিতই, এবং ইলিশ ভাজা সাতলার ঐতিহ্যবাহী খাবারের অন্যতম।
থাকার ব্যবস্থা:
সাতলা গ্রামে থাকার জন্য কোনো নির্দিষ্ট হোটেল বা রেস্ট হাউজ নেই। গ্রামবাসীদের আন্তরিকতায় স্থানীয় বাড়িতে থাকতে পারেন। তবে পূর্বেই তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে নিলে সুবিধা হবে। এছাড়াও বরিশাল শহরে বিভিন্ন মানের আবাসিক হোটেল পাওয়া যায়, যেখানে আপনি নিরাপদে থাকতে পারেন।
সাতলা বিলের শাপলার উৎসব:
প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে শাপলার প্রস্ফুটন উপলক্ষে সাতলায় এক ধরনের উৎসবের আমেজ শুরু হয়। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ এসে এই শাপলা দেখার জন্য সমবেত হয়। এখানকার স্থানীয়রা তখন তাঁদের তৈরি হস্তশিল্প, পিঠা, এবং অন্যান্য খাদ্যদ্রব্য বিক্রির জন্য ছোট ছোট দোকান বসায়। এ এক প্রাণবন্ত পরিবেশ, যেখানে স্থানীয়দের জীবনযাত্রা, তাঁদের সংগ্রাম, এবং আনন্দ সব মিলিয়ে ভিন্ন এক অনুভূতির সৃষ্টি হয়।
সাতলা বিলে ভ্রমণের সময় মনে রাখবেন:
সাতলা বিলে ভ্রমণের সবচেয়ে ভালো সময় হল ভোরবেলা। কারণ তখন সূর্যের আলো শাপলার পাপড়িতে মিলে এক অভূতপূর্ব সৌন্দর্যের সৃষ্টি করে। ভ্রমণের সময় অবশ্যই পর্যাপ্ত পানি, ক্যামেরা, আর শুকনো খাবার নিয়ে যাবেন। স্থানীয় পরিবেশ রক্ষা করতে গাছপালা বা শাপলা না তুলে শুধু চোখের সান্নিধ্যেই প্রকৃতির রূপ উপভোগ করুন।
সাতলা বিল কেবলমাত্র প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের একটি স্থান নয়, এটি স্থানীয়দের জীবনযাত্রা, তাঁদের সংস্কৃতি এবং অতিথিপরায়ণতার একটি মেলবন্ধন। শাপলার এই রাজ্যে এসে আপনি শুধুমাত্র প্রকৃতির সাথে মিলিত হবেন না, বরং এই গ্রামবাসীদের আন্তরিকতা, ঐতিহ্যবাহী খাবার, এবং তাঁদের সংগ্রামী জীবনযাত্রার সাথে পরিচিত হতে পারবেন। সাতলা বিল তাই প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য একটি অবিস্মরণীয় গন্তব্য, যেখানে প্রকৃতির সান্নিধ্যে একটি দিন কাটানো মানে জীবনের কিছু অমূল্য মুহূর্ত উপভোগ করা।
সাতলা বিলের শাপলার সৌন্দর্য এবং স্থানীয়দের জীবনযাত্রা সম্পর্কে জানার পর যে কেউই নিশ্চয়ই সেখানে যেতে উদগ্রীব হবেন। প্রকৃতির এই অবিশ্বাস্য রূপ উপভোগ করতে, আপনিও সাতলা বিলে চলে আসুন এবং স্থানীয়দের আন্তরিকতার স্পর্শে নিজেকে হারিয়ে ফেলুন। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক রত্ন এই সাতলা বিল যেন আমাদের প্রকৃতির সৌন্দর্যের প্রতীক হয়ে থেকে যায়।

About The Author

You May Also Like

More From Author

+ There are no comments

Add yours