রুদ্র মোহাম্মদ ইদ্রিস ॥ আমার এক খালা ছিলেন, যিনি প্রায় প্রতিবছর একবার আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসতেন। সেই সময় সাথে করে উপহার হিসেবে আনতেন একখানি নামাজ পড়ার উপযোগী শীতলপাটি। আমার শৈশবে আমাদের বাড়ির পেছনে বাঁশঝাড় আর শীতলপাটি তৈরীর মুক্তাগাছের বড় একটি আড়া ছিলো। আড়া মানে ঝোঁপ। যার অবশিষ্টাংশ এখনও বর্তমান। কিন্তু ব্যবহার হয় না কোনো কাজে। গ্রামে বিয়ে হলে বরযাত্রার সাথে একটি বড় আকারের মাছ আর একটি শীতলপাটি থাকতেই হবে-এমনটাই রেওয়াজ ছিলো একসময়।
শীতলপাটি গ্রাম-বাংলার হাজার বছরের ঐতিহ্য। গ্রাম কিংবা শহরের সৌখিন মানুষদের কাছে শীতলপাটির কদর অনেক। তবে বর্তমানে উন্নতমানের মাদুর ও প্লাস্টিকের রেক্সিন আবিষ্কারের কারণে হ্রাস পেয়েছে শীতলপাটির কদর ও উৎপাদন। এছাড়াও শীতলপাটি তৈরির কাঁচামালের দাম অনেক। এসব নানা কারণে এখন বিলুপ্তির পথে হাজার বছরের এ ঐতিহ্য ও হস্তশিল্প।
শীতলপাটি বুননের কাঁচামাল হচ্ছে মুক্তা বেত, আমাদের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ভাষায় যাকে বলা হয় পাটিবেত । যা শুষ্ক মৌসুমে রোপণ করা হয়। বেত পরিপক্ব হলে বর্ষার পানিতে ভিজিয়ে পাটি তৈরির উপযোগী বেতে পরিণত করা হয়। এরপর চলে পাটি বুনন। এখনো গ্রামাঞ্চলের বিয়েতে কনের সঙ্গে শীতলপাটির উপহার ধরাবাঁধা নিয়ম হিসেবেই রয়ে গিয়েছে। এছাড়াও বেতের তৈরি নামাজের মুসল্লা বা মাদুরেরও রয়েছে সমান কদর। ২০১৭ সালের ৬ ডিসেম্বর বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে শীতলপাটির স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘ শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থার কাছে (ইউনেসকো)।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে মুক্তা বা পাটিবেতের অস্তিত্ব থাকলেও নানা কারণে শিল্পটি এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে গৃহায়ন বেড়ে যাওয়ায় উজাড় হচ্ছে বেতবন।
এছাড়াও একটি চার হাত বাই পাঁচ হাত পাটি তৈরিতে কমপক্ষে ১৬০টি মুক্তা বেতের প্রয়োজন পড়ে। যার বাজার মূল্য এক সময় ৫০০ থেকে নিয়ে ৮০০ টাকা ছিল। যা এখন কিনতে হচ্ছে এক থেকে দেড় হাজার টাকায়। এছাড়াও বর্তমানে উন্নতমানের মাদুর ও প্লাস্টিকের রেক্সিন আবিষ্কারের কারণে হ্রাস পেয়েছে শীতলপাটির মূল্য ও উৎপাদন।
এছাড়াও এগুলো যারা তৈরী করতেন, সেইসব শৌখিন কারিগরের সংখ্যাও দিনে দিনে কমে আসছে।
সদর উপজেলার সুহিলপুর গ্রামের আ. রউফ মিয়া বলেন, আজ থেকে বিশ-পঁচিশ বছর আগের প্রত্যেকটি ঘরের গৃহিনীরা ভাত রান্নার মতো করে পাটি বুননের কাজ জানতো। কিন্তু রেক্সিন ও প্লাস্টিকের মাদুর আবিস্কার এবং ফেসবুক-অনলাইনের আসক্তির ফলে এখনকার মেয়েরা পাটি বানাতে জানে না।
নন্দনপুর বাজারের বেতশিল্প ব্যবসায়ী সেগু মিয়া বলেন, গ্রামাঞ্চলে বাড়িঘর বৃদ্ধি পাওয়ায় উজাড় হচ্ছে বেতবন। ফলে কাঁচামালের বিলুপ্তি ও মূল্য বৃদ্ধির কারণে এ শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন।
ভাদুঘরের আবুল হোসেন বলেন, মুক্তা যদি বানিজ্যিকভাবে উৎপাদন করা যায়, তাহলে এটাকে শিল্পে রূপান্তর করা যেতে পারে।
মূলত এই মুক্তা বেতশিল্প একদিকে প্রাকৃতিক ও স্বাস্থ্যসম্মত। অপরদিকে তা আমাদের ঐতিহ্য এবং ক্ষুদ্রশিল্পের অন্তর্ভুক্ত। আর তাই ক্ষুদ্র ঋণের ব্যবস্থা করে এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা এখন সময়ের দাবী।
+ There are no comments
Add yours