মানুষ কী? কেন মানুষ?

॥ ইদরীস মুহাম্মদ ॥

মানুষ কেবল একটি জীবজন্তু নয়, বরং প্রকৃতির এক অতুলনীয় সৃষ্টি। আমাদের অস্তিত্বের প্রশ্ন বহু যুগ ধরে মানব জাতির চিন্তার বিষয় হয়ে আসছে। মানুষ কী? কেন মানুষ? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার চেষ্টা বিজ্ঞান, দর্শন, ধর্ম ও সাহিত্য সব জায়গায় হয়ে এসেছে। মানুষ শুধু দেহ নয়, একটি আত্মা, বুদ্ধি, অনুভূতি ও সংস্কৃতির সমন্বয়।
মানুষের অস্তিত্ব পৃথিবীর অন্যান্য জীবের থেকে আলাদা, কারণ তার রয়েছে বুদ্ধি, চিন্তাশক্তি ও সমাজ গঠনের ক্ষমতা। আমরা কেবল বেঁচে থাকি না, বরং অর্থপূর্ণ জীবন যাপন করতে চাই। এই প্রবন্ধে আমরা বিশ্লেষণ করবো মানুষকে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে এবং কেন আমরা মানুষ, এই প্রশ্নের উত্তর সন্ধান করবো। ১. মানুষের সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য
মানুষ শব্দের অর্থ হলো ‘হোমো স্যাপিয়েন্স’ (ঐড়সড় ংধঢ়রবহং)। এটি মানববিজ্ঞান এবং জীববিজ্ঞানের ভাষায় আধুনিক মানুষের নাম। মানুষের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো উচ্চতর বুদ্ধিমত্তা, ভাষার ব্যবহার, এবং সামাজিক জীবন।

মানুষের দেহ কাঠামো সশরীর হলেও তার মস্তিষ্ক, চিন্তাশক্তি ও অনুভূতি তাকে অন্য প্রাণীর থেকে আলাদা করে। মানুষ স্মৃতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, কলা ও বিজ্ঞান সৃষ্টি করে জীবনের মান উন্নত করে। তার জ্ঞান, অনুভূতি, ও সৃজনশীলতা তাকে স্বতন্ত্র করে তোলে।
২. জীববিজ্ঞানী দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষ
বিজ্ঞানী মতে, মানুষ জীববিজ্ঞানের শ্রেণীবিভাগে প্রাইমেট গোত্রের অন্তর্ভুক্ত। বিবর্তনবাদের আলোকে দেখা যায়, মানুষ প্রাচীন কোন প্রাইমেট থেকে বিবর্তিত। তাঁর দেহ কাঠামো, মস্তিষ্কের ক্ষমতা, দুই পায়ে হাঁটা ইত্যাদি বৈশিষ্ট্য বিবর্তনের ফল।
মানবদেহের অনেক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যেমন হাতের পাঁচ আঙ্গুল, চোখের দৃষ্টি, ও শাব্দিক ভাষা ব্যবহার ইত্যাদি তাকে অন্যান্য প্রাণীর থেকে আলাদা করেছে। বিবর্তনের মাধ্যমে তার মস্তিষ্ক ব্যাপক বিকাশ লাভ করেছে যা তার জটিল চিন্তা ও সমস্যা সমাধানে সাহায্য করে।
ইসলাম ধর্ম মতে মানুষ কী এবং কেনো?
ইসলাম ধর্মে মানুষকে আল্লাহর সৃষ্টির অন্যতম শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মানুষ শুধুমাত্র এক জীবন্ত প্রাণী নয়, বরং তার সৃষ্টি একটি উদ্দেশ্য, তা হলো আল্লাহর বন্দনা করা এবং পৃথিবীতে সঠিক জীবন যাপন করা। মানুষকে “খলিফা” বা অধিপতি হিসেবে সৃষ্টি করা হয়েছে, যাতে সে পৃথিবীতে ন্যায়, শান্তি ও উন্নতি স্থাপন করতে পারে।
মানুষ কী? ইসলামের দৃষ্টিতে, মানুষ হলো আল্লাহর সৃষ্টি, যাকে তিনি মাটির মিশ্রণ থেকে সৃষ্টি করেছেন। কুরআন ও হাদিসে মানুষের সৃষ্টি এবং তার গুণাবলী ব্যাপকভাবে বর্ণিত আছে। আল্লাহর সৃষ্টির অংশ: কুরআনুল কারিমে বলা হয়েছে, আল্লাহ মাটির ক্লান্তিকর মিশ্রণ থেকে আদম (প্রথম মানুষ) সৃষ্টি করেন (সূরা স্দা: ২৭)। আত্মার মালিক: আল্লাহ মানুষের মধ্যে আত্মা প্রবিষ্ট করেছেন (সূরা স্দা: ৭২)। বুদ্ধি ও বিবেক: মানুষের মধ্যে আল্লাহ বুদ্ধি ও বিবেক দিয়েছেন, যা তাকে অন্য জীবের থেকে আলাদা করে (সূরা বাকারা: ৩১)। ২. মানুষ কেনো সৃষ্টি? ইসলামে মানুষের সৃষ্টি একটি উচ্চতর উদ্দেশ্য পূরণে হয়েছে, যা আল্লাহর ইচ্ছার প্রতিফলন। কুরআনে বলা হয়েছে: আল্লাহর ইবাদত করার জন্য: “আমি জিন ও মানুষকে কেবল আমার ইবাদত করার জন্য সৃষ্টি করেছি।” (সূরা যিন: ৫৬) পৃথিবীর খলিফা হিসেবে: আল্লাহ মানুষকে পৃথিবীর খলিফা (প্রতিনিধি) হিসেবে সৃষ্টি করেছেন, যার মাধ্যমে পৃথিবীতে ন্যায়, শান্তি ও সৃজনশীলতা প্রতিষ্ঠা করা হবে (সূরা বাকারা: ৩০)। পরীক্ষার জন্য: মানুষের জীবনকে একটি পরীক্ষার মঞ্চ হিসেবে দেখা হয়, যেখানে তারা তাদের কর্মের ভিত্তিতে পুরস্কৃত বা শাস্তি পাবে (সূরা মুলক: ২)।
৩. মানুষের গুণাবলী ও দায়িত্ব: আখলাক ও নৈতিকতা: ইসলাম মানুষকে সৎ, ন্যায়পরায়ণ ও দয়ালু হতে শিক্ষা দেয়। জ্ঞান অর্জন: কুরআনে জ্ঞানার্জনের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। মানুষের জন্য জ্ঞান অর্জন ও প্রয়োগ একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।
সৃষ্টির অধিকারী: মানুষ পৃথিবীর সম্পদ ব্যবহার করে উন্নয়ন ঘটাতে পারে, তবে তা আল্লাহর বিধান অনুযায়ী করতে হবে। সম্পর্ক ও দায়িত্ব: মানুষ সমাজের অংশ, তাই অন্যদের প্রতি সদয় ও দায?িত্বশীল হওয়া প্রয়োজন।
৪. মানব জীবনের উদ্দেশ্য ও পরিণতি: মানুষকে ধৈর্য্য, ভালোবাসা, প্রার্থনা এবং নিয়মানুবর্তিতা সহকারে জীবনযাপন করতে বলা হয়েছে। মৃত্যু পরবর্তী জীবনের বিশ্বাস ইসলামে গুরুত্বপূর্ণ; যেখানে মানুষ তার পৃথিবীতে করা কাজের প্রতিদান পাবে (সূরা আলে ইমরান: ১৮৫)। এই জীবন ক্ষণস্থায়ী, আর আসল জীবন পরকাল। তাই জীবনের উদ্দেশ্যই হলো পরকালের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া।
শেষ কথা; ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষ শুধু মাটির এক সৃষ্টিজীব নয়, বরং আল্লাহর উদ্দেশ্যমূলক পরিকল্পনার অংশ, যাকে দায?িত্ব এবং সম্মানের সাথে জীবনযাপন করতে বলা হয়েছে। মানুষ সৃষ্টি হয়েছে আল্লাহর ইবাদত ও পৃথিবীতে তাঁর খলিফা হিসেবে কাজ করার জন্য। তাই প্রতিটি মানুষের জীবনের মানে হলো আল্লাহর আদেশ পালন, ন্যায়পরায়ণতা এবং আত্মার পরিপূর্ণতা অর্জন।