জীবন পথে ভাঙ্গা গড়ার খেলা-ছোট একটি সিদ্ধান্তে বদলে দিলো সব ॥ দুঃখের বদলে সুখের সংসার

Spread the love


আল আমীন শাহীন ॥ গ্রামীণ একটি শালিস সভায় দুটি চোখ উদ্বেগ উৎকণ্ঠায়। চোখ দুটি ঘুরে ঘরে দেখছে সবাইকে। শালিসকারকরা নানা কথা বলছে, সেই কথায় চোখ দুটো কখনো জ্বলে উঠছে, কখনো লাল ক্ষোভে, কখনো পানিতে ভেজা। এমন সভায় মেয়েটি দেখেছে সবাইকে। কিছুই বলেনি। বিয়ে হয়েছে তার এক বছর পূর্বে। ছেলে প্রবাসী মেয়ে সুখে থাকবে এই ভেবে অভিভাবকরা বয়স কারসাজি করে বিয়ের কাজ সম্পন্ন করেছিল। বিয়ের পর স্বামী চলে যায় প্রবাসে। শহরে জন্ম নেয়া স্কুল পড়ুয়া মেয়েটি বউ সেজে গিয়েছে শ্বশুর বাড়ি। গৃহস্তির সংসার। বড় উঠোন, মাটির চ’লা ,গোয়াল ঘর সবই আছে কিন্তু এতে অভ্যস্ত নয় সে। সনাতনী সংসার ধর্ম তেমন বুঝেনি। বিয়ের এক মাস পর স্বামী চলে যায় প্রবাসে। শ্বশুড় শ্বাশুড়ি সেবা সংসার সামলাতে গিয়ে বিপাকে পড়ে মেয়েটি। দ্বন্ধটা সেখান থেকে দিনে দিনে বাড়ে। দ্বন্ধ বিরোধে এ কথা সে কথা। এনিয়ে পারিবারিকভাবে দেন দরবার শেষে তা সামজিক শালিসে আসে। এক বছর পর স্বামী ফেরত আসে প্রবাস থেকে। এক দিকে তার পিতা মাতার নানা অভিযোগ, স্ত্রীর অমনোযোগিতা সব মিলিয়ে সে অনেকটা নির্বাক “শ্যাম রাখি না কুল রাখি।” পারিবারিক কলহে মেয়েটি চলে আসে বাপের বাড়ি। নানা ঘটনায় আবারো শালিস , নানা রস বেরসের কটু কথা, শেষ পর্যন্ত সাংসারিক ভাবে বিছিন্নতার অভাসে স্বামী স্ত্রী দুজনই চুপ হয়ে যায়। শালিস সভায় মুরুব্বীরা নানা কথা বলছে তাই তাদের মুখ থেকে কথা হারিয়ে যায়। চলমান সামাজিক জীবনে শালিস সভায় একে অপরে কথার জোরে হার জিতের প্রতিযোগিতায় সাধারণ মানুষ অনেকটা অসহায় হয়ে পড়ে। সঠিক সিদ্ধান্ত না হলে অনেকের জীবন হয় বিপর্যস্ত। মেয়েটির ভাগ্য তেমনই দুদোল্যমান। নানা কথা অভিযোগ দুপক্ষের , শেষ পর্যন্ত এক বছরে সাংসারিক জীবনের বিচ্ছন্নতার সিদ্ধান্ত হয়। ছেলে পক্ষে সংসার করাবে না, আর মেয়ে পক্ষ ভাত খাওয়াবে না। এ সিদ্ধান্ত রায়ের পর্বে দেন মোহর দিতে হবে মেয়েকে সাথে খোরপোষ কিছু ক্ষতির জরিমানা, প্রায় ৭ লক্ষ টাকা। টাকা জমা হয় শালিসকারকদের টেবিলে। নদীর এ পাড় ওপাড় যেমন ঠিক তেমনই পরিস্থিতি । এদিকে স্বামীর স্ত্রীর একে পরে চোখে চোখে কথা। স্বামী কে দাড়ঁ করালেন কাজী সাহেব। সবার সম্মুখে তাকে উচ্চারণ করতে বলা হলো, আমি অমুক এমন গ্রাম নিবাসী এমুকের কন্যাকে স্বজ্ঞানে তালাক দিলাম । ছেলেটি স্বজ্ঞান পর্যন্ত এসে আর কিছু বলছে না থমকে গেছে। আবার বল্লেন কাজী সাহেব, বলুন আমি স্বজ্ঞানে তালাক দিলাম এক তালাক । স্বামীটি নিঃশ্চুপ। অবশেষে ছেলেটি ছুটে গেল তারা বাবার কাছে , গিয়ে বল্ল , বাবা তুমি আমাদের ক্ষমা করে দাও, আমি আমার বউকে নিয়ে সংসার করবো। পুরো শালিস সভা অবাক, এবার ছেলেটি কথা বলছে সবাই চুপ করে শুনছে। ছেলেটি বল্ল, আপনারা সবাই আমাদের জন্য দোয়া করবেন, ভুল ভ্রান্তি যা আছে আমরা শোধরে নেব , আপনারা সহযোগিতা করবেন। বলেই ছেলেটি এগিয়ে গেল তার স্ত্রীর কাছে , মেয়েটি অঝরো কাঁদছে, আর একসময় ছেলেটির হাত ধরে এগিয়ে এসে মুরুব্বীদের সালাম করলো। পুরো শারিস সভা চুপ এর মাঝে এক বৃদ্ধ হাত তালি দিয়ে দাড়িয়ে গেল, সবাই তখন একসাথে হাততালি দিল।
এ ঘটনা প্রায় দু মাস আগের, সেদিন যাচ্ছিলাম সে গ্রামের পাশ দিয়ে সেখানে দেখি নতুন একটি শাড়ি পড়ে হাস্যোজ্জ্বল মেয়েটি উঠোনে, তার শ্বশুড় একটি চেয়ারে বসা , দুজনে কি জানি শলা-পরামর্শ করছে। সুখের একটি হাওয়া বয়ে গেল মনে। আমাকে দেখে দুজনই এগিয়ে এলো আর বল্ল, আমরা এখন ভালই আছি। জীবনের এই ঘটনাটি গল্প নয় সত্য ঘটনা। বাল্য বিবাহের বিরূপ প্রতিক্রিয়া, সাংসারিক শিক্ষার অভাব, অধৈর্যতা, ছোট বিষয়কে বড় করে দেখলে কি ক্ষতি হয় এবং এ থেকে বাঁচতে সময় উপযোগী সিদ্ধান্ত প্রয়োজন আর সঠিক সিদ্ধান্তে দুঃখের বদলে সুখ আসে সেই দৃষ্টান্তই দেখলাম।

About The Author

You May Also Like

More From Author

+ There are no comments

Add yours