মহাসড়কে কোমর সমান পানি, ৫০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে দাঁড়িয়ে যানবাহন

Spread the love

অনলাইন ডেস্ক::


কুমিল্লার বাসিন্দা মো. সামছুল আলম গত বুধবার কক্সবাজার ঘুরতে গিয়েছিলেন। ওইদিন রাতেই ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লা ও ফেনীতে পানি ওঠার খবর জানতে পারেন তিনি। মহাসড়ক ডুবে গেলে কক্সবাজারে আটকা পড়তে পারেন এই শঙ্কায় কিছুটা অস্বস্তি নিয়েই গত বৃহস্পতিবার সকাল ৯টায় হানিফ পরিবহনের একটি বাসে করে কুমিল্লার উদ্দেশে কক্সবাজার থেকে রওনা দেন তিনি। চট্টগ্রামের বারৈয়ারহাট পার হওয়ার পরই মহাসড়কের কয়েকটি স্থানে পানি দেখতে পান তিনি।
ওইদিন বিকেলে সাড়ে ৩টায় তাদের বহনকারী বাসটি ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলার লেমুয়া নামক স্থানে পৌঁছে। এরপর থেকে একই স্থানে পরদিন শুক্রবার সকাল ৭ টা পর্যন্ত অপেক্ষা করলেও বাসটি আর এক ইঞ্চিও সামনে আগায়নি। আশপাশের কোনো খাবার দোকানে খাবার না পেয়ে রাতেও সামছুল আলমকে থাকতে হয়েছে না খেয়ে। বাধ্য হয়ে বাস থেকে নেমে শুক্রবার সকাল ৭টার দিকে পায়ে হেঁটেই সামনের দিতে রওনা দেন তিনি।
কিছুদূর যেতেই দেখেন মহাসড়ক ভাসছে পানিতে। শুরুতে হাঁটু ও কোমর সমান পানি হলেও একটু দূর যেতেই বুক সমান পানি। সেই সঙ্গে রয়েছে পানির তীব্র স্রোত। প্রায় ৪ ঘণ্টা এমন পানির পথ মাড়িয়ে ফেনী সদরের মহিপাল এলাকায় পৌঁছান সামছুল।
এরপর বিভিন্ন যানবাহনে ভেঙে ভেঙে ওই দিন দুপুরে কুমিল্লায় পৌঁছান তিনি। বাসায় এসে গতকাল শুক্রবার বিকেলে খবর নিয়ে জানতে পারেই তাকে বহনকারী বাসটি এখনো আগের যায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছে!
ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলার লেমুয়া থেকে মহিপাল পর্যন্ত এলাকাটি প্রায় সাড়ে ৮ কিলোমিটার দীর্ঘ। এরমধ্যে অন্তত ৬ কিলোমিটার মহাসড়কই বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে টানা বৃষ্টি ও ভারত থেকে হু হু করে নেমে আসা পানিতে ভাসছে। পরিস্থিতি খারাপ হওয়ায় বন্ধ রয়েছে মহাসড়কের যান চলাচল। এরই মধ্যে তীব্র স্রোত ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এই মহাসড়ক।
মূলত এ কারণেই যান চলাচল বন্ধ থাকায় এমন দুর্ভোগে পড়েছিলেন কুমিল্লার বাসিন্দা মো. সামছুল আলম। তবে সামছুল একা নন, তাঁর মতো কয়েক হাজার মানুষও পড়েছেন এমন দুর্ভোগে। ঘটনাস্থলে সরেজমিনে থেকে দেখা গেছে, মানুষের এই দুর্ভোগ ছিল অবর্ণনীয়। ভুক্তভোগীদের ভাষ্য, এমন ভয়াবহ দুর্ভোগে তাদের কেউই পড়েননি আগে। আর স্থানীয়রা বলছেন, মহাসড়কে এমন পানি উঠতে আগে কখনো দেখেননি তাঁরা।
গতকাল শুক্রবার দুপুরে ভুক্তভোগী মো. সামছুল আলম বলেন, বৃহস্পতিবার বিকেল থেকেই আমার মতো হাজার হাজার যাত্রী এই ভয়ানক বিপদের মধ্যে পড়েন। তবে সবচেয়ে বেশি বেকায়দায় পড়েছেন নারী ও শিশুরা। কয়েক হাজার বাস যেখানে থেমেছে, এখনো সেখানেই আটকে আছে। আশপাশের বাড়িঘর সব কিছু পানির নিচে। বানভাসী মানুষ তাদের গবাদীপশু নিয়ে মহাসড়কের ডিভাইডারে আশ্রয় নিয়েছেন। আশপাশে কোথাও কোনো খাবারের দোকান নেই। পুরো রাতটা কেটেছে আতঙ্কের মধ্যে।
তিনি বলেন, সকালে যখন বুঝলাম যানচলাচল সহজে শুরু হবে না, তখন ঝুঁকি নিয়েই হেটে রওনা হই। কোমর ও বুক সমান পানিতে প্রায় ৪ ঘণ্টা হেঁটে অবশেষে বাসায় ফিরতে পেরেছি। ফেরার সময় দেখেছি স্রোতে অনেক মানুষ ভেসে গেছেন। বিশেষ করে লালপোল এলাকায় এক দম্পতি তাদের শিশু সন্তানসহ ভেসে যান। পরে কিছুদূর গিয়ে স্বামী-স্ত্রী গাছের সঙ্গে আটকে গেলেও তাদের শিশু সন্তানের শেষ পরিণতি কী হয়েছে সেটা বলতে পারব না। আমি কয়েক মিনিট পর চলে এসেছি।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, দুই দিক মিলিয়ে অন্তত ৫০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে কয়েক হাজার যানবাহন আটকে রয়েছে। গত বৃহস্পতিবার দুপুরের পর থেকে এখানে এসে আটকে পড়া যানবাহনগুলোর বেশির ভাগই দূরপাল্লার বাস। শতাধিক বাস ও ট্রাক পানি মাড়িয়ে পার হতে গিয়ে বিকল হয়ে পড়ে রয়েছে মহাসড়কে। এছাড়া কোথাও কোথাও লাশবাহী গাড়ি ও অ্যাম্বুলেন্সও দাাঁড়িয়ে ছিল দুই দিন ধরে।
তীব্র স্রোতের কারণে মহাসড়কের বিভাজকে থাকা গাছগুলো উপচে পড়েছে। বিভাজকগুলোর মাটি স্রোতে ভেসে গেছে। এরপরও পানির মধ্যে নিজেদের গবাদীপশু নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন বানভাসী মানুষ। আশপাশে কোথাও নেই খাবারের দোকান। দুই একটি দোকান যা ছিল তার খাবার গত বৃহস্পতিবার বিকেলের মধ্যেই মানুষজন কাড়াকাড়ি করে কিনে নিয়ে গেছেন। আশপাশে শৌচাগার না থাকায় নারীরা পড়েন চরম বেকায়দায়। কারণ আশপাশের সব বাড়িঘরও পানিতে তলিয়ে গেছে।
কক্সবাজার থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দিয়ে একইভাবে আটকেপড়া বাসের যাত্রীদের আরেকজন সাদিয়া পুতুল। বুক সমান পানি হেঁটে পার হতে পারবেন না বলে শুক্রবার সকালে চট্টগ্রামে এক আত্মীয়ের বাসায় ফিরে যাওয়ার জন্য রওনা দিয়েছেন তিনি। ফেনী থেকে বারৈয়ারহাট পর্যন্ত হেঁটে গিয়ে অবশেষে যানবাহনে উঠতে পেরেছেন তিনি।
সাদিয়া পুতুল বলেন, জীবনে কখনো এমন ভয়াবহ পরিস্থিতিতে পড়িনি। ভয় ও আতঙ্ক নিয়ে পুরোটা রাত কাটিয়েছি বাসের মধ্যে। বলতে গেলে সারারাতই জেগে ছিলাম। খাবারের অভাবে মানুষের হাহাকার খুব কাছ থেকে দেখেছি। আমাদের বাসে কয়েকজন ভানবাসী মানুষ উঠেছিলেন নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার জন্য। তাদের মধ্যে একটি শিশু জ্বরে কাঁপছিল। কিন্তু বাবা-মা শিশুটিকে ওষুধ তো দূরে থাক একটু খাবারও দিতে পারছিলেন না। পানির কারণে কাছাকাছি কোথাও কোনো ওয়াশরুমও ছিল না। কতটা কষ্ট করেছি বলে বোঝাতে পারব না। আশপাশে কোনো খাবারের দোকান না থাকায় মানুষ খাদ্য সংগ্রহ করতে পারেনি। আমাদের বাসে অনেক যাত্রী রাতে না খেয়ে ছিলেন। যারা ভালো খেতে পেরেছেন সেটা হলো সর্বোচ্চ বিস্কুট।
গতকাল শুক্রবার দুপুরে সোহেল রানা নামে আরেক যাত্রী বলেন, পানি কখন কমবে সেই অপেক্ষায় মানুষ সারাদিন থেকে সারারাত বাসে বসে আছেন। পেছনে গাড়ির দীর্ঘ সারি এবং উল্টোপথও বন্ধ হয়ে থাকায় ফিরে যাওয়ারও উপায় নেই। যার কারণ্যে বাধ্য হয়ে বেশিরভাগ মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দীর্ঘ স্রোতের পথ পানি মাড়িয়ে গন্তব্যে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। যান চলাচল বন্ধ থাকার বিষয়টি আগে জানলে রওনা হতাম না।
এদিকে, বৃহস্পতিবার বিকেল থেকেই ওই এলাকায় খাদ্য সংকট তীব্র হয়ে পড়ে। রাতে খাবারের অভাবে প্রায় প্রতিটি বাসেই আটকেপড়া শিশুদের কাঁদতে দেখা গেছে। এতে শিশুদের অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে পড়ে। এতে অনেক শিশু অসুস্থ হয়ে পড়ে। কিন্তু তাদের চিকিৎসা বা সহায়তা দেওয়ার মত কোনো পরিস্থিতি ছিল না। এতে শিশুদের নিয়ে বাবা-মা অসহায় অবস্থার মধ্যে পড়েছেন।
ফেনী শহরের বাসিন্দা অটোরিকশা চালক দুলাল মিয়া বলেন, আমার বয়স ৫৫ বছর। এই বয়সে কখনো ফেনী শহর বা মহাসড়কে এভাবে পানি উঠতে দেখিনি। মহাসড়কে চলাচলকারী যাত্রীদের এমন ভয়াবহ দুর্ভোগ আগে কখনো দেখিনি। এতো পরিমাণ মানুষ যেকোনো দোকানে এক প্যাকেট বিস্কুটও ছিল না। শুক্রবার সকালে মহিপাল এলাকায় অনেক স্বেচ্ছাসেবীদের মানুষের জন্য শুকনো খাবার নিয়ে আসতে দেখেছি।
শুক্রবার বিকেলে লেমুয়া এলাকায় আটকে থাকা বাস চালক হুমায়ুন কবির বলেন, এমন দুর্ভোগে জীবনে কখনো পড়িনি। বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে গাড়ি নিয়ে একই স্থানে দাঁড়িয়ে আছি। মনে হচ্ছে আজ রাতও এখানেই কাটাতে হবে। কখন ঢাকায় ফিরবো বলতে পারছি না। ৪২ জন যাত্রী নিয়ে কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম থেকে এসেছি। এখনো কয়েকজন গাড়িতে বসে আছেন। বাকিরা নিজ দায়িত্বে পানি পার হয়ে চলে গেছেন। এই দুর্ভোগ বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না।

About The Author

You May Also Like

More From Author

+ There are no comments

Add yours