অনলাইন ডেস্ক:
গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রচুর পরিমাণে স্বর্ণ কিনেছে। ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধ ও গাজার সংঘাতের পাশাপাশি চীনের এ পদক্ষেপের কারণে বিশ্বব্যাপী স্বর্ণের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যে সুদের হার কমানোর চেষ্টা ও চীনের স্বর্ণ জমার করার কারণে এ সপ্তাহে প্রথমবারের মতো মূল্যবান এ ধাতুটির দাম দুই হাজার ২১২ ইউরো ছাড়িয়েছে।
বিনিয়োগকারীরা বৈশ্বিক অস্থিরতা ও মুদ্রাস্ফীতির সময় স্বর্ণকে একটি নিরাপদ বিনিয়োগ হিসাবে বিবেচনা করেন। তাই করোনা পরবর্তী সময়ে অতিরিক্ত মুদ্রাস্ফীতি, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউক্রেনে চলমান সংঘাত স্বর্ণের সাম্প্রতিক মূল্য বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছে। চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক, পিপলস ব্যাংক অফ চায়নার (পিবিসি) এই পদক্ষেপে উন্নয়নশীল অন্যান্য দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোও প্রভাবিত হয়েছে। তারাও স্বর্ণের রিজার্ভ বাড়াতে আগ্রহী হয়ে উঠছে।
চীন আসলে কী করছে?
ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের মতে, পিবিসি সবশেষ ১৬ মাস ধরে তার স্বর্ণের রিজার্ভ বাড়িয়েছে। ২০২৩ সালে অন্যান্য দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তুলনায় পিবিসি বেশি স্বর্ণ কিনেছে। সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে চীন ২২৫ মেট্রিক টন স্বর্ণ কিনেছে। যা বিশ্বের অন্য সব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কেনা এক হাজার ৩৭ টনের প্রায় এক চতুর্থাংশ। এ মুহূর্তে চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্টে প্রায় দুই হাজার ২৫৭ টন স্বর্ণ মজুদ আছে। পিবিসির পাশাপাশি, চীনের সাধারণ নাগরিকেরাও স্বর্ণের মুদ্রা, বার ও গহনা কিনছেন।
ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের প্রধান মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজিস্ট জন রিড গত মাসে ব্লুমবার্গ টিভিকে বলেন, ‘‘বছরের শুরু থেকেই আমরা চীনকে বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ কিনতে দেখেছি। চীনের অভ্যন্তরীণ সাংহাই গোল্ড এক্সচেঞ্জে রেকর্ড পরিমাণ বেচাকেনা দেখেছি।”
এত স্বর্ণ কেনার কি কারণ?
বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাণিজ্যের জন্য চীন মার্কিন ডলারের উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। বিশ্বের সংরক্ষিত মুদ্রা হিসাবে, বেশিরভাগ পণ্যের দাম ডলারে হয় ও বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি বাণিজ্য মার্কিন ডলার ব্যবহার করে পরিচালিত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য গত ৩০ বছরে চীন বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করেছে, যার বেশিরভাগই ডলার।
একই পরিস্থিতি ব্রিকস (ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন এবং দক্ষিণ আফ্রিকা) গোষ্ঠীর অন্যান্য দেশগুলোর সঙ্গেও সামঞ্জস্যপূর্ণ। এ দেশগুলোর অর্থনীতি ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্ব অর্থনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করতে প্রস্তুত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ব্রিকস ভবিষ্যতে একটি অভিন্ন মুদ্রা চালু করার কথাও ভাবছে। যা বিশ্বের সবেচেয়ে নিরাপদ মুদ্রা হিসাবে পরিচিত মার্কিন ডলারকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে।
চীন কেন ডলার থেকে বৈচিত্র্য আনতে চায়?
ওয়াশিংটন তার বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান বজায় রাখতে ডলারকে কিভাবে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করে তা নিয়ে চীনসহ ব্রিকস এর সদস্য দেশগুলো উদ্বিগ্ন। ডলারে বিনিময়ের কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অনেক কম খরচে ঋণ নিতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, রাশিয়া, ইরান ও উত্তর কোরিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার সময় ওয়াশিংটন এই মুদ্রাকে কূটনীতির হাতিয়ার হিসাবেও ব্যবহার করতে পারে।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের পর, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক রিজার্ভ জব্দ করাসহ মস্কোর উপর বেশ কয়েক দফা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। মার্কিন চাপের মুখে, বেশিরভাগ রাশিয়ান ব্যাংককে সুইফট পেমেন্ট সিস্টেম থেকে বের করে দেওয়া হয়। সুইফট পেমেন্ট সিস্টেম আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সহজেই লেনদেন করা যায়।
এছাড়াও ভবিষ্যতে চীন যদি তার সামরিক শক্তি আরও কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেয় বা ওয়াশিংটনের সাথে বাণিজ্য যুদ্ধে জড়ায়, তাহলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একইরকম নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হতে পারে বলে চিন্তিত চীনের রাজনৈতিক নেত্রীবৃন্দ। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বলেছেন, তার দেশ প্রয়োজনে বলপূর্বক তাইওয়ানকে পুনরায় দখল করতে পারে। গণতান্ত্রিকভাবে পরিচালিত এই দ্বীপ রাষ্ট্রটিকে বেইজিং তার অংশ হিসেবে বিবেচনা করে।
ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের বিশ্লেষকেরা ধারণা করছেন, চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বর্ণ কেনার এই ধারা আরও কয়েক বছর ধরে চলমান থাকবে। এ প্রক্রিয়াটিকে ডলারের বিকল্প তৈরির একটি সংকেত হিসেবে দেখছেন তারা।
সূত্র : ডয়চে ভেলে।
+ There are no comments
Add yours