মোহাম্মদ ফাহিমুল ইসলাম
সোনালী ব্যাংক, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক-বিডিবিএল, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক ও অগ্রণী ব্যাংক। সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক-বিডিবিএল, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের সঙ্গে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক-রাকাব অচিরেই একীভূত হবে বলে গভর্নরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর এমডিদের আলাদা সভায় জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। সে অনুযায়ী পর্ষদ সভায় সিদ্ধান্ত নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানাতে বলা হয়েছে। আর তা না হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজ উদ্যোগে এসব ব্যাংক একীভূক করবে বলে সভায় উপস্থিত সূত্র জানিয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, বেসিক ব্যাংককেও রাষ্ট্রায়ত্ত একটি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার আলোচনা হয়েছে। এছাড়া বেসরকারি বেশ কয়েকটি ব্যাংক একীভূত করার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে রাষ্টায়ত্ত সোনালীর সঙ্গে বিডিবিএল এবং কৃষি ব্যাংকের সঙ্গে রাকাব একীভূত অচিরেই করার সিদ্ধান্তের কথা কেন্দ্রীয় ব্যাংক এমডিদের জানিয়ে দিয়েছে। সে অনুযায়ী তাদের সিদ্ধান্ত দ্রুত নেওয়ার জন্যও বলা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক জানান, সবল ব্যাংকগুলোর সঙ্গে দুর্বল ব্যাংক একীভূত করতে ধারাবাহিক মিটিং বাংলাদেশ ব্যাংকে হচ্ছে। তবে কখন কোন ব্যাংক একীভূত করা হবে তা আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হবে।
এদিকে, সবল ব্যাংকের সঙ্গে দুর্বল ব্যাংক একীভূত হওয়ার নীতিমালা জারি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ থেকে জারি করা নীতিমালায় একীভূত হলে ব্যাংকগুলো কি সুযোগ সুবিধা পাবে সেসব বিষয়ে বলা হয়েছে। তবে একীভূত হলে দুর্বল ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও উপব্যবস্থাপনা পরিচালকরা চাকরি হারাবেন এবং দুর্বল ব্যাংকের পরিচালক আগামী ৫ বছর অন্য কোনো ব্যাংকের পরিচালক হতে পারবেন না বলেও নীতিমালায় বলা হয়েছে।
নীতিমালায় অনুযায়ী, খারাপ অবস্থায় থাকা ব্যাংকগুলো নিজ থেকে একীভূত না হলে বাধ্যতামূলকভাবে একীভূতকরণ করা হবে। একীভূতকরণের আগে দুই ব্যাংকের মধ্যে একটি সমঝোতা সই করতে হবে। এরপর বিস্তারিত পরিকল্পনা বিশেষ করে আমানতকারী, সব পাওনাদার ও বিনিয়োগকারীর অর্থ ফেরতের পরিকল্পনা জমা দিতে হবে। এরপর বাংলাদেশ ব্যাংক বহিঃনিরীক্ষক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ব্যাংকের সার্বিক আর্থিক চিত্র বের করবে। বিভিন্ন প্রক্রিয়া শেষে সর্বশেষ আদালতের কাছে একীভূতকরণের আবেদন করতে হবে।
এর আগে খেলাপি ঋণ, মূলধন ঘাটতি, ব্যবস্থাপনা ও তারল্য— এই চারটি সূচকের ভিত্তিতে একটি পিসিএ ফ্রেমওয়ার্ক দেওয়া হয়েছে। সেই সূচকে কাঙ্ক্ষিত মানদণ্ডের নিচে থাকা ব্যাংকগুলোকে ‘দুর্বল’ শ্রেণিভুক্ত করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। দুর্বল ব্যাংক টেনে তোলার শেষ পদক্ষেপ হিসেবে অন্য ভালো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার বিষয়টি থাকছে। সরকারও তাতে সায় দিয়েছে। সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইনে দ্রুত সংশোধনমূলক ব্যবস্থা বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষমতার আলোকে গত ৫ ডিসেম্বর পিসিএ ফ্রেমওয়ার্ক শীর্ষক সার্কুলার জারি করা হয়।
এতে বলা হয়, কোনো ব্যাংক মূলধন ও তারল্য ঘাটতি, উচ্চমাত্রার খেলাপি ঋণ, সুশাসনের ঘাটতি এবং সর্বোপরি আমানতকারীদের জন্য ক্ষতিকর কার্যকলাপের কারণে পিসিএ ফ্রেমওয়ার্কের আওতাভুক্ত হলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক পুনরুদ্ধারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিধি-নিষেধ মানতে হবে। পুনরুদ্ধার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হলে আমানতকারীদের স্বার্থে ব্যাংকের বাধ্যতামূলক একীভূতকরণ করা হবে। একীভূতকরণ প্রক্রিয়া শৃঙ্খল এবং সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হওয়ার লক্ষ্যে ব্যাংকের অনুসরণের জন্য এই নীতিমালা জারি করা হলো।
এতে আরও বলা হয়েছে, একীভূত হওয়ার পর আমানতের অর্থ পরিশোধের ক্ষেত্রে ব্যক্তি শ্রেণির আমানতকারীর অর্থ পরিশোধ বা তাদের হিসাব ও ব্যাংকিং লেনদেন সচল করার বিষয়টিকে সাধারণভাবে অগ্রাধিকার দিতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকারীর অর্থ নির্দিষ্ট সময়ে সম্পূর্ণ পরিশোধের একটি পরিশোধ কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক ওই কর্মপরিকল্পনা পরীক্ষা-নিরীক্ষান্তে বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তাবিত পরিকল্পনাটিতে, প্রয়োজনীয় পরিবর্তনসহ বা পরিবর্তন ব্যতীত, অনুমোদন দেবে।
নীতিমালা অনুযায়ী, একীভূত হওয়া ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ৩ বছরের মধ্যে ছাঁটাই করতে পারবে না। তবে ৩ বছর পর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কর্মদক্ষতার মূল্যায়ন করে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। একীভূত হওয়ার পর দুর্বল ব্যাংকের পরিচালক তার পদ হারাবেন। এমনকি ৫ বছরের মধ্যে তিনি ব্যাংকের পরিচালক হতে পারবেন না। বিলুপ্ত ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও উপব্যবস্থাপনা পরিচালককে একীভূত ব্যাংকের কোনো পদে রাখা যাবে না। তবে একীভূত ব্যাংকের পর্ষদ বিলুপ্তির পর এমডি, এএমডি ও ডিএমডিকে উপযুক্ত মনে করলে নতুন করে চুক্তির ভিত্তিতে কোনো পদে নিয়োগ করা যাবে।
সরকারি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান হলে সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের এমডি, এএমডি ও ডিএমডিকে সরকার তার অন্য ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সমপদে বহাল বা বদলি করতে পারবে। একীভূত হওয়ার পর বিলুপ্ত ব্যাংকের ঋণ যেন খেলাপি না হয়ে যায় এবং ঋণগুলোর তদারকি ও খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য পৃথক ইউনিট গঠন করতে হবে। অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি গঠিত হওয়ার পর ঋণ বা বিনিয়োগের বিপরীতে গৃহীত সহায়ক জামানতসহ উক্ত খেলাপি ঋণ বা বিনিয়োগ বিক্রয় করা যাবে।
একীভূতকরণের পদ্ধতি
দুই বা তার অধিক ব্যাংক বা ক্ষেত্রমতে আর্থিক প্রতিষ্ঠান যদি একীভূত হওয়ার বিষয়ে একমত হয়, তবে ওই ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো নিজ নিজ পর্ষদে বিষয়টি উপস্থাপন করে নীতিগত অনুমোদন গ্রহণ করবে। এরপর তারা বাংলাদেশ ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোতে তালিকাভুক্ত হলে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের কাছ থেকে অনুমোদন নেবে। এরপর হস্তান্তর গ্রহীতা ব্যাংক এবং হস্তান্তরকারী ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান তার বা যে অংশ অধিগ্রহণ করা হবে তার নিরীক্ষা, আর্থিক এবং আইনি কাজ সম্পন্ন করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক তার তালিকাভুক্ত নিরীক্ষা ফার্ম থেকে এক বা একাধিক নিরীক্ষা ফার্মকে নিয়োগ দেবে।
এক্ষেত্রে ওই নিরীক্ষা এবং আর্থিক ও আইনি কাজ সম্পন্ন করার খরচ বহন করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। আমানতকারী, পাওনাদার ও শেয়ারহোল্ডারদের দাবি পরিশোধসহ সম্পূর্ণ একত্রীকরণ কার্যক্রম সুষ্ঠু ও যথাযথভাবে সম্পাদনের উদ্দেশ্যে সংশ্লিষ্ট নিরীক্ষা ফার্ম তার নিরীক্ষা এবং আর্থিক ও আইনি কার্যক্রম প্রতিবেদন বাংলাদেশ ব্যাংকের নিকট দাখিল করবে। এসব বিষয় সম্পাদনকালে তথ্যের গোপনীয়তা বজায় রাখবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক। এতে ব্যর্থ হলে বাংলাদেশ ব্যাংক তার প্রদত্ত অনুমোদন বাতিল করতে পারবে।
নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতিবেদন বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে জমা হলে ওই প্রতিবেদন গ্রহীতা ও হস্তান্তরকারী কোম্পানিকে দেওয়া হবে। এরপর তারা নিজ নিজ পরিচালনা পর্ষদে উপস্থাপন করে অনুমোদন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। শেয়ারহোল্ডার বা পাওনাদারদের সম্মতির জন্য বিশেষ সভা আহ্বান করে বিশেষ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। এক্ষেত্রে পাওনাদার বা শেয়ারহোল্ডার অথবা সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠের সম্মতি গ্রহণ করতে হবে। একত্রীকরণ সংক্রান্ত স্কীম বিশেষ সাধারণ সভায় অনুমোদনের পর হস্তান্তর গ্রহীতা ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের সম্মতির জন্য আবেদন করবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সন্তুষ্টির পর এটি কার্যকর করার জন্য হাইকোর্ট বিভাগের নিকট অনুমোদনের জন্য আবেদন দাখিল করবে।
হাইকোর্ট অনুমোদনের বিষয়ে অনাপত্তি দিলে হস্তান্তর গ্রহীতা ও হস্তান্তরকারী কোম্পানি জয়েন্ট স্টক কোম্পানির রেজিস্ট্রারের নিকট নিবন্ধন করার জন্য হাইকোর্টের আদেশের কপি দাখিল করবে। সে অনুযায়ী, স্কীমটি বাস্তবায়নের জন্য শেয়ারহোল্ডাররা ও অন্যান্য অংশীদারগণের অবগতির জন্য নোটিশ প্রদানপূর্বক প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে এবং স্কিমের একটি কপি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের নিকট প্রেরণ করবে। এসব বিধান অনুসরণ করে দুইটি প্রতিষ্ঠান একীভূত হবে।
+ There are no comments
Add yours