রুদ্র মোহাম্মদ ইদ্রিস
কবি ও গীতিকার মোঃ আঃ কুদদূস এর কবিতাগ্রন্থ “বাঁধন”। এটি নির্ঝর প্রকাশনী প্রকাশ করেছে। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে এটি বাজারে এসেছে। বইটির মুল্য ৩০০ টাকা। অত্যন্ত যত্ন আর দরদ দিয়ে গড়া চমৎকার প্রচছদ দেখেই বইটি হাতে নিতে ইচছা করে। প্রচছদ শিল্পী হাসান । বইটিতে সর্বমোট ৯৫টি কবিতা রয়েছে। বইটি লেখক ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তাঁর সারথিদের উৎসর্গ করেছেন ।
বইয়ের ভেতরের প্রতিটি কবিতার শিরোনাম বেশ চমৎকার। সবগুলো কবিতা থেকেই কিছু কিছু পড়েছি । বেশ ভালো লেগেছে । এমন কিছু কবিতা আছে যা পড়লে মনে হয় এইতো আমার নিজের কথা । আমার মনের কথা । আমার দেশের কথা। প্রিয়ার জন্য আমার বলতে না পারার কথা। এসময় বড় আপন মনে হয় তাঁকে- মানে কবিকে। তাঁর কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য প্রেম, দ্রোহ, প্রকৃতি। অনেকগুলো কবিতায় কবি হয়ে উঠেছেন আন্তর্জাতিক। চমৎকার শব্দের গাঁথুনি, উপমা, মিল ও চিত্রকল্পের অসামান্য ব্যবহার তাঁর কবিতাগুলোকে দিয়েছে এক নতুন মাত্রা। আধুনিক দুর্বোধ্য শব্দের ব্যবহার না করে তিনি পাঠকদের প্রাণের চাহিদাকেই বেশী প্রাধান্য দিয়েছেন-এবিষয়টি আমাকে একজন কবিতার পাঠক হিসেবে বেশ আলোড়িত করেছে। তিনি কবিতায় অত্যন্ত সরল ও সাবলীলভাবে বাস্তবতাকে আমাদের চোখের সামনে জীবন্ত করে তুলে ধরেছেন তাঁর নিপুণ হাতের মায়াবী স্পর্শে ।
ভালোবাসি ভোরের পাখি
ভালোবাসি শিমুল ফুলের ঘ্রাণ
(ভোরের পাখি- পৃ: ০৪)
তুমি থাকো ফুলের মতো
আছি তো আমি মৌমাছি।
তোমার বুক চষে
চুষে আনি মধু
গড়ে তুলি মধুচাক…..। ( জন্মভুমি পৃ: ২২)
তোমার সুখের লাগিয়া
নিঠুর হাতে
শক্ত আঘাতে
ভাঙিলে মোর সংসার…..(ঘর ভেঙে…পৃ:৫১)
বেদনাবিহীন মানব জীবন
তারকাহীন আকাশের মতো (অমোঘ বিধি-পৃ: ৮৭)
তার কবিতায় প্রকৃতিপ্রেমি কবির অন্তর্গত দারুন শূন্যতা কবিকে সর্বদা প্রবলভাবে আকর্ষণ করে। বিশ্বব্রহ্মান্ডের এহেন অসীম রাজ্যে কবি হয়ে যান একা ভীষন একা । তিনি উদাসী হাওয়ায় ভেসে ভেসে কবিতায় তোলে আনেন প্রকৃতির নির্যাস নিপুণ হাতে। তখন তাঁর কবিতা হয়ে ওঠে প্রাণময় ও আবেগময়।
জীবনানন্দ দাশের মতো তাঁর কবিতায় প্রকৃতি এখানে অনেকটাই রূপক। কারণ এই কবিতাকে বুঝতে হলে, আগে বুঝতে হবে কবিকে। কারণ আসাদ চৌধুরীর মতে, কবিতার স্বাদ নিতে হলে জীবনানন্দকে পড়তেই হবে। তেমনি প্রকৃতির স্বাদ নিতে মোঃ আঃ কুদদূস এর বাঁধন পড়তে আমি ব্যক্তিগতভাবে তরুণদের অনুরোধ করবো।
এই বইয়ে আমার যেসব কবিতা সব থেকে বেশি ভালো লেগেছে, সন্ধ্যার পাতা, মৌমাছির স্বপ্ন, ছবি অভিযোগ, কোলাহল, অন্ধ, শালবনে, হলদে পাখিরা, বিসর্জন, নিপাত যাক, ছায়া, ঘর ভেঙ্গে, আবাহন, আমার বাড়ি,নদী ও জীবন ইত্যদি।
তাঁর সবগুলো কবিতার গতর নির্মাণ বেশ পাকা হাতের। সবচেয়ে অবাক করার বিষয় হলো তিনি কথিত দুর্বোধ্য শব্দের ব্যবহার করে পাঠককে বিভ্রান্তিতে ফেলতে চাননি। যারফলে তাঁর কবিতাগুলো পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে খুব সহজেই।
যখন সমাজ দেহ থেকে খসে পড়তে থাকে মূল্যবোধের পলেস্তারা, যখন বিশ্ব বিবেককে কামড়ে খায় ঘুণপোকা, তখন কবির কবিতায় উঠে আসে দ্রোহ। বিদ্রোহের বার্তা নিয়ে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলে কবির ধ্যান, চিন্তা। এখানে তার কবিতা আঘাত করে দেশকাল ছাপিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে । তাঁর বিদ্রোহী সত্তা আঘাত হানে দ্রাঘিমার শেষ প্রান্তে । নিজের অমঙ্গল হলেও তিনি বিশ্ব মানবতার কল্যাণে নিজেকে বিলিয়ে দেন। কবি মোঃ আঃ কুদদূস এর ব্যতিক্রম নন। তার লেখায় সমানভাবে এগিয়েছে প্রেম ও দ্রোহ।
বিশেষ করে যখন আমরা বিবেকহীন পশু হয়ে যাই তখন একজন কবিকে মানুষ হিসেবে সবচেয়ে বেশি আহত করে । আর তখনি কবির কবিতায় কবি হয়ে উঠেন প্রেমহীন বিদ্রোহী। সমকালীন ভাবনা কবি মোঃ আঃ কুদদূসকে আলোড়িত করে সবচেয়ে বেশী। বিশেষ করে সমকালীন ঘটনা প্রবাহ, কী জাতীয় কী আন্তর্জাতিক একজন কবির কবিতায় ওঠে আসে অনায়াসে।
স্মৃতি কখনো মুছে ফেলা যায়না । জামার ময়লা ডিটারজেন্ট দিয়ে ধূয়ে ফেলা যায় । কিন্তু স্মৃতি কখনো ধুয়ে ফেলা যায়না। মুছে ফেলা যায়না মনের গহীন অরণ্য থেকে । বহুদিন পর ও কড়া নাড়ে,শৈশব-কৈশোর-যৌবনের সব ফেলে আসা স্মৃতির প্রজাপতিরা । এই হিরন্ময় স্মৃতি নিয়ে আমরা অনেক কবিতায় তাঁর সরব উপস্থিতি দেখতে পাই।
প্রেম শাশ্বত । প্রেম চিরন্তন । প্রেমহীন জীবনের কথা ভাবা যায়না । বিশেষ করে মানব জীবনের তারুণ্যের প্রেম মানুষকে অতিমাত্রায় ভাবাবেগের দোলায় দুলিয়ে থাকে । মনে হয় যেন প্রেমহীন জীবন এক মরুভূমি মাত্র।
কবি ও গীতিকার মোঃ আঃ কুদদূস ১৯৮১ সালে বরগুনায় এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহন করেন। তিনি বর্তমানে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট) হিসেবে কর্মরত আছেন। পেশাগত দায়ত্ব পালনের পর- অবসর সময়ে তিনি সাহিত্যস্বাদে নিমগ্ন থাকেন।
একজন কবি মোঃ আঃ কুদদূস মানুষ প্রশাসক ও কবি। কবিতায়, কর্মে, প্রশাসক হিসেবে সবসময়ই মানুষকে প্রাধান্য দিয়েছেন এবং দেন। তাঁর কথা কর্ম ও সাহিত্য সাধনায় নিরলস পরিশ্রম তার মানবপ্রেম ও স্রষ্টাপ্রেমকে আরও শানিত করে। আমি বাঁধন এর সফলতা ও বহুল প্রচার কামনা করছি।
বই আলোচনায়: রুদ্র মোহাম্মদ ইদ্রিস
কবি ও সাংবাদিক
ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
+ There are no comments
Add yours